ফলিক এসিডের গুরুত্ব ও উপকারিতা বিস্তর। বিশেষ করে, গর্ভধারণের আগে থেকেই দরকার ফলিক এসিড খাওয়া।
গর্ভধারণের আগের পর্যায়ে ব্রেকফাস্টে বিভিন্ন ফর্টিফায়েড খাদ্যশস্য খাওয়া উচিত। এ ছাড়া ফর্টিফায়েড ডাল জাতীয় শস্য, পালং শাকও যেন লাঞ্চ বা ডিনারের প্লেটে থাকে।
এই নির্দিষ্ট খাবারগুলো মায়ের শরীরে ফলিক এসিডের জোগান দেয়। ফলিক এসিড (Folic acid) গর্ভধারণের জন্য প্রয়োজনীয় অন্যতম পুষ্টি উপাদান!
ফলিক এসিড কী?
Folic acid হলো এক ধরনের ভিটামিন-বি। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ভাষায়, প্রাকৃতিকভাবে এই ভিটামিনটি বিশেষ পাওয়া যায় না, শরীরকে তৈরি করে নিতে হয়।
ফোলেটের সিন্থেটিক রূপ (Form) হলো ফলিক এসিড। মানুষের শরীরে নতুন কোষ উৎপাদনে সহায়তা করে ফলিক এসিড।
ডিএনএ তৈরির ক্ষেত্রে এটিই মুখ্য ভূমিকা পালন করে। প্রিন্যাটাল অর্থাৎ গর্ভধারণের আগের পর্যায়ে ফলিক এসিড নারীশরীরকে গর্ভধারণের উপযুক্ত করে তোলে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভ্রুণের নিউরাল টিউব গঠন ও তার বেড়ে ওঠার জন্যও ফলিক এসিড প্রয়োজন। ভ্রুণের মস্তিষ্কের গঠনেও এর ভূমিকা রয়েছে।
ফলিক এসিড ও ফোলেটের তফাৎ
অনেকেই ফলিক এসিড ও ফোলেটকে একই উপাদান বলে মনে করেন। প্রকৃতপক্ষে এই দু’টি সম্পূর্ণ আলাদা । ফোলেট গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে বেশ কয়েকটি ভিটামিন-বি ।
এর মধ্যে Folic acid হলো প্রধানতম। এ ছাড়া ফোলেট গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে ডাইহাইড্রোফোলেট, টেট্রাহাইড্রোফোলেট নামের আরো কিছু ভিটামিন-বি।
কখন খাওয়া উচিত?
মেয়েদের সন্তানধারণের বয়স হওয়ার পর থেকেই Folic acid খাওয়া শুরু করা উচিত। এতে বেশি বয়সেও মেয়েরা শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে না।
সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) সংস্থার মতে, ফলিক এসিড গর্ভধারণের অন্তত একমাস আগে থেকে প্রতিদিন খাওয়া উচিত।
প্রেগন্যান্সি চলাকালীন ও সন্তান জন্ম নেওয়ার পরেও ফলিক এসিড খাওয়া চালিয়ে যেতে হবে।
গর্ভধারণের প্রথম কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ভ্রুণের সুষুম্নাকাণ্ড তৈরি হয়। এই সময় ভ্রুণের জন্য ফলিক এসিড অত্যন্ত জরুরি।
একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, যেসব মায়েরা গর্ভধারণের একবছর আগে থেকে ফলিক এসিড খান, তাদের ক্ষেত্রে প্রিম্যাচিউর বার্থের আশঙ্কা অনেকটাই কমে যায়।
কতটা খাওয়া উচিত
গর্ভাবস্থার আগে ও গর্ভাবস্থায় Folic acid খাওয়া উচিত। তবে সব পর্যায়ে এর পরিমাণ এক নয়।
চিকিৎসকের মতে, গর্ভধারণের আগে ফলিক এসিড দিনে ৪০০ মাইক্রোগ্ৰাম খাওয়া উচিত।
গর্ভধারণের পর প্রথম তিনমাস প্রতিদিন ৫০০ মাইক্রোগ্ৰাম খেতে হবে। চতুর্থ মাস থেকে নবম মাস পর্যন্ত প্রতিদিন ৬০০ মাইক্রোগ্ৰাম ফলিক এসিড খাওয়া উচিত।
চিকিৎসকের কথায়, এই সময় ভ্রুণের চাহিদা মেটাতেই ফলিক এসিড বেশি পরিমাণে প্রয়োজন হয়।
সন্তান জন্মের পরে ব্রেষ্ট ফিডিং পর্যায়ে মায়ের প্রতিদিন ৫০০ মাইক্রোগ্ৰাম ফলিক অ্যাসিডের প্রয়োজন।
ফলিক এসিডের উৎস
Folic acid সাপ্লিমেন্টের আকারে বাজারে পাওয়া যায়। যেসব মাল্টিভিটামিনে অন্তত ৪০০ মাইক্রোগ্ৰাম ফলিক এসিড থাকে, সেই মাল্টিভিটামিনই মায়ের জন্য উপযুক্ত।
এ ছাড়া চাল, গম, ওটস্ ও ডালজাতীয় শস্য থেকে তৈরি ফর্টিফায়েড খাবারেও এ ভিটামিন থাকে।
কিছু নির্দিষ্ট ধরনের পাউরুটিতেও ফলিক এসিড থাকে। এ ছাড়া পালং শাকও ফলিক এসিডের উৎস।
ফলিক অ্যাসিডের উপকারিতা
১. নিউরাল টিউবে অস্বাভাবিকতা
নিউরাল টিউবের শেষ অংশ ঠিকমত বন্ধ না-হলে এতে অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। এর ফলে সন্তানের জন্মের পর নানারকম সমস্যাও দেখা দিতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ফলিক এসিড নিয়মিত খেলে ভ্রুণের নিউরাল টিউবের অস্বাভাবিকতা ৫০ শতাংশ কমে যায়।
এ ছাড়া প্রথম সন্তানের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক নিউরাল টিউব থাকলে পরের সন্তানের ক্ষেত্রেও তা থাকার আশঙ্কা থাকে। তবে নিয়মিত Folic acid খেলে এই আশঙ্কা ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কমানো সম্ভব।
এক্ষেত্রে ফলিক অ্যাসিডের ডোজ চিকিৎসক ৪০০ মাইক্রোগ্ৰাম থেকে বাড়িয়ে দেন। ডোজ কতটা হবে, সেটা চিকিৎসকই বলে দিতে পারবেন।
২. স্পাইনা বিফিডা
গর্ভধারণের প্রথম মাসেই ভ্রুণের সুষুম্নাকাণ্ড তৈরি হয়। এই সুষুম্নাকাণ্ড বা ভার্টিব্রার গঠন সম্পূর্ণ না-হলে স্পাইনা বিফিডার সমস্যাটি দেখা দেয়।
এই সমস্যা সদ্যোজাতের শরীরে দেখা দিলে তার একাধিক অপারেশন করার প্রয়োজন পড়ে। এই সমস্যার ফলে সদ্যোজাত স্থায়ীভাবে পক্ষাঘাতেও আক্রান্ত হয়ে যেতে পারে।
তাই গর্ভাবস্থায় যথেষ্ট পরিমাণে Folic acid ভ্রুণকে দেওয়া উচিত।
৩. অ্যানেনসেফালি
ফলিক অ্যাসিডের অভাবে নানারকম সমস্যা দেখা যায়। বিশেষজ্ঞদের কথায়, এদের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ সমস্যা হল অ্যানেনসেফালি।
অনেক সময় দেখা যায়, গর্ভে থাকাকালীন ভ্রুণের মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ সম্পূর্ণ তৈরি হয়নি। বিজ্ঞানের পরিভাষায় একেই অ্যানেনসেফালি বলা হয়।
এসব ক্ষেত্রে সদ্যোজাত শিশুটির আয়ুও কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, গর্ভধারণের আগে থেকে Folic acid নিয়মিত খেলে ভ্রুণের এই সমস্যা এড়ানো সম্ভব।
৪. জন্মগত অস্বাভাবিক হৃৎপিণ্ড
অনেক সময় ভ্রুণের হৃৎপিণ্ড ও হৃৎপিণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকা রক্তনালী সঠিকভাবে গড়ে ওঠে না। এতে হৃৎপিণ্ডের ভিতরের দেওয়াল ও ভালভগুলি ক্ষতিগ্ৰস্ত হয়।
এ ছাড়া হৃৎপিণ্ড থেকে নির্গত ধমনীগুলিও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা একেই কনজেনিটাল হার্ট ডিফেক্ট বলেন। গর্ভাবস্থায় Folic acid সাপ্লিমেন্ট নিয়মিত খেলে ভ্রুণের শরীরে এই সমস্যা দেখা দেয় না।
৫. ক্লেফ্ট লিপ ও ক্লেফ্ট প্যালেট
গর্ভাবস্থায় Folic acid না-খেলে ভ্রুণের এমন সমস্যাও দেখা দিতে পারে।
এক্ষেত্রে জন্মের সময় শিশুর নাকের নীচে থাকা উপরের ঠোঁটটির অংশ মাঝখান থেকে চেরা হয়। চেরা অংশটি নাকের সঙ্গে গিয়ে মিলিত হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ফলিক অ্যাসিডের অভাবেই শিশুর ঠোঁটের এমন অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়।
৬. প্রিম্যাচিউর বার্থ
Folic acid সমৃদ্ধ খাবার বা সাপ্লিমেন্ট নিয়মিত খেলে শিশুর প্রিম্যাচিউর বার্থও সহজে এড়ানো যায়। প্রিম্যাচিউর বার্থে শিশুর শরীর বাইরের পরিবেশের সঙ্গে মানাতে পারে না।
এ ছাড়া প্রিম্যাচিউর শিশুর ওজনও স্বাভাবিক ওজনের থেকে কম হয়। Folic acid গর্ভাবস্থায় ভ্রুণের কোষ বিভাজনে সাহায্য করে।
ডিএনএ গঠনে সাহায্য করায় এটি ভ্রুণের প্রিম্যাচিউর বার্থও প্রতিরোধ করে।
৭. মিসক্যারেজ
গর্ভপাত বা মিসক্যারেজ যে কোনও মায়ের জন্যই অত্যন্ত দুঃখের। গবেষণায় দেখা গিয়েছে এর পেছনে নানা কারণ থাকতে পারে।
যার মধ্যে অন্যতম কারণ হল ফলিক অ্যাসিডের অভাব।
ফলিক অ্যাসিডের অভাবের ফলে জরায়ু থেকে ভ্রুণের শরীরে সঠিক পরিমাণে পুষ্টি সরবরাহ হয় না।
চিকিৎসকরা তাই পরামর্শ দেন, গর্ভধারণের অনেক আগে থেকেই ফলিক এসিড খাওয়া উচিত। এতে মায়ের জরায়ুও সন্তানধারণের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি সংগ্ৰহ করতে পারে।
—ডেস্ক পেরেন্টিং