ঘরে বসে কিংবা ক্লিনিকে প্রেগন্যান্সি টেস্ট : কোথায়, কখন, কীভাবে ও কেন করবেন? মা হতে গেলে জানা খুব জরুরি।
যেসব দম্পতি মনের দিক থেকে এক্কেবারে প্রস্তুত ঝটপট পৃথিবীতে নতুন প্রজন্ম নিয়ে আসার জন্য, তাদের কাছে মনে হয় প্রত্যেকটা দিনই চাপা উদ্বেগের।
যে যতই গলা ফাটিয়ে চিৎকার করুক না, কনসিভ করার ক্ষেত্রে টেনশন বা উদ্বেগ ব্যাপারটা একটুও ভালো নয়।
মুখে বলে, এই তো দিব্যি ফুর্তিতে আছি, আর মনে বলে, কালকে দুটো দাগ আসবে তো?
যারা মা হওয়ার বয়সটাকে ছুঁয়ে ফেলেছেন, তারা বেশ বুঝতে পারছেন আমরা কোন দুটো দাগ নিয়ে কথা বলছি।
হ্যাঁ, প্রেগন্যান্সি কিট দিয়ে বাড়িতে টেস্টের বিষয়টা অনেকেই জানেন, তবে ভাসা-ভাসা।
আবার, এতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যায়ও না সবার সাথে।
ফলস্বরূপ, মনের মধ্যে জাঁকিয়ে বসে বিভ্রান্তি আর অশান্তি।
শরীরে কোনো পরিবর্তন বুঝলে একবার কেন, হাজার বার আপনি টেস্ট করুন বা করান, তবে কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন মেনে।
অন্যথায় সঠিক রেজাল্ট তো আসবেই না, ভুলভাল ভাবনায় জর্জরিত হবেন আপনি।
সঠিক সময় এবং নিয়ম মেনে যদি প্রেগন্যান্সি কিট ব্যবহার করেন, তার সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা ৯৯ শতাংশ।
বাকি ১ শতাংশে হ্যাঁ বা না নির্ণয় করবেন একমাত্র চিকিৎসক, প্রাথমিকভাবে পজিটিভ রেজাল্ট এলে তার পরে ক্লিনিক্যাল টেস্টে পজিটিভ বা নেগেটিভ সিলমোহর বসাতে পারেন আপনার চিকিৎসকই।
প্রাথমিকভাবে বাড়িতে টেস্ট কিট ব্যবহার করলে কখন, কীভাবে এই টেস্ট করবেন—
অথবা কী উপায় মেনে চললে রেজাল্ট ঠিক আসার সম্ভাবনা বাড়বে, এসব নিয়ে আজ থাকছে বিস্তারিত আলোচনা।
কখন, কীভাবে টেস্ট করবেন
১. প্রেগন্যান্সি টেস্ট কেন যত জলদি সম্ভব করানো উচিত?
খটকা লাগলো তো পয়েন্টটা পড়েই? আপনি হয়তো ভাবছেন, এটা আবার একটা প্রশ্ন হল?
হ্যাঁ, আমি জানি, প্রেগন্যান্ট বলে নিশ্চিত হয়ে কেউ প্রেগন্যান্সি টেস্ট করায় না।
অথবা নিজের শরীর যদি মা হওয়ার সিগন্যাল দিতে শুরু করে, কেউ টেস্ট না-করে বাড়িতে বসে থাকে না। কিন্তু বাস্তব যে অন্য কথা বলে!
সে-কারণে সাবধানের মার নেই—এই তত্ত্বই মেনে চলি আমরা। সবসময় আগাম সতর্ক করতে থাকি আপনাদের।
যারা ‘মা’ হওয়ার জন্য মনে মনে প্রস্তুত, তারা পারলে রোজ একবার করে টেস্ট করেন—যা একেবারেই ভুল।
কিন্তু যে তরুণী ‘মা’ হওয়ার কোনো প্ল্যানই করেনি বা হঠাৎ করেই ঘটে গেছে ভালোবাসার বিড়ম্বনা, তার বেলা?
যা হয়ে যাক না কেন, পরবর্তী সময়ে শরীরে কোনোরকম বেভাব দেখলে বা পিরিয়ড মিস করলে সঙ্গে সঙ্গে প্রেগন্যান্সি কিট এনে টেস্ট করুন।
নিজের শরীর সবথেকে ভালো বুঝবেন নিজে। পরামর্শ নিন চিকিৎসকের।
শারীরিক অস্বস্তিকে চেপে গেলে বা শরীরের নির্দেশকে অগ্রাহ্য করলে, চরম ক্ষতি পারে আপনার নিজের এবং ভাবী সন্তানের।
তাই সময় থাকতেই এতটুকু অন্যরকম বুঝলে বাড়িতে টেস্ট করার পর সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের কাছে যান।
২. প্রেগন্যান্সি টেস্ট কী তত্ত্বের ওপর কাজ করে?
যে কোনো প্রেগন্যান্সি টেস্টে ক্ষেত্রে শেষ হাসিটা হাসে হবু মায়ের শরীরে উপস্থিত একটি বিশেষ হরমোন। এই হরমোনকে আদর করে প্রেগন্যান্সি হরমোন বলা হয়ে থাকে।
ডাক্তারি ভাষায় এর পরিচিতি হিউম্যান কোরিওনিক গোনাডোট্রপিন হরমোন হিসেবে।
ভ্রূণ জরায়ুগাত্রে স্থাপিত হওয়ার ১০ থেকে ১৪ দিন পরে হবু মায়ের রক্তে এবং মূত্রে এর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
কনসিভ করার পরে হবু মায়ের শরীরে এই এইচসিজি (HCG) হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়। অমরা বা প্লাসেন্টা তৈরির দায়িত্বে থাকা কোষই এই হরমোন নিঃসরণ করে।
এইচসিজি হরমোনের মাত্রার ওপর নির্ভর করেই প্রেগন্যান্সি টেস্টের ফলাফল নির্ধারিত হয়।
কনসিভ করার ৮-১১ সপ্তাহের মধ্যে এই হরমোনের মাত্রা সবথেকে বেশি হয়।
কোনো নারীর শরীরে এইচসিজি (HCG) হরমোনের মাত্রা যদি ৫ এম আই ইউ/ মিলিলিটার (5 mIU/ml)-এর থেকে কম হয়, সেক্ষেত্রে রেসাল্ট নেগেটিভ।
নারীর শরীরে এইচসিজি (HCG) হরমোনের মাত্রা যদি ২৫ এম আই ইউ/মিলিলিটার (25 mIU/ml)- এর সমান বা তার বেশি হয়, তা হলে প্রেগন্যান্সি রেসাল্ট পজিটিভ।
৩. প্রেগন্যান্সি টেস্ট কীভাবে করা হয়ে থাকে?
প্রেগন্যান্সি টেস্ট দু’ভাবে করা হয়ে থাকে। এক, মূত্র বা ইউরিন টেস্ট এবং দুই, রক্তপরীক্ষা বা ব্লাড টেস্ট।
ক. মূত্র বা ইউরিন টেস্ট(Urine test) : এই টেস্টটি হলো প্রাথমিক—যা আপনি বাড়িতেই করতে পারেন।
বাজারে যে সমস্ত প্রেগন্যান্সি কিট কিনতে পাওয়া যায়, তার সাহায্যেই এই টেস্টটি ঘরে করে ফেলা সম্ভব।
তবে, সঠিক রেজাল্ট পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়াতে চাইলে ভালো নামী কোম্পানির প্রেগন্যান্সি কিট কিনুন এবং প্যাকেটের গায়ে লেখা নির্দেশাবলী ভালো করে মেনে চলুন।
টেস্ট কিটে যে কেমিক্যাল স্ট্রিপ থাকে, তাতে মূত্রের নমুনা দিয়ে এই টেস্ট করা যায়।
আপনি ইউরিন সংগ্রহ করে তাতে প্রেগন্যান্সি স্ট্রিপ ডোবাতে পারেন, ড্রপারে করে ইউরিনের নমুনা যথাস্থানে দিতে পারেন বা ফ্লো চলাকালীন নির্দিষ্ট জায়গা বুঝে সেটি ধরতে পারেন।
বিভিন্ন ব্র্যান্ডের কিটের রেসাল্ট দেখানোর সময় ভিন্ন রকম। তবে, সাধারণত ১-২ মিনিটের মধ্যে রেজাল্ট দেখা যায়।
বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্রেগন্যান্সি কিটের রেসাল্ট দেখানোর পদ্ধতি ভিন্ন।
কোনো ক্ষেত্রে রঙের পরিবর্তন হয়, কোনো ক্ষেত্রে লাইন দিয়ে বোঝানো হয়, কোনো ক্ষেত্রে পজিটিভ না নেগেটিভ চিহ্ন ওঠে, আবার কোথাও লেখার মাধ্যমে দেখানো হয় রেসাল্ট।
আবারো বলছি, যে কোনো প্রেগন্যান্সি টেস্ট কিট ব্যবহারের আগে তার নির্দেশাবলী ভালোভাবে পড়ে নিন।
খ. রক্ত পরীক্ষা(Blood test) : এই রক্ত পরীক্ষা আপনি বাড়িতে করতে পারবেন না। ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে মেডিক্যাল ক্লিনিকেই এই পরীক্ষা করা হয়ে থাকে।
নারীর রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে এই প্রেগন্যান্সি টেস্ট করা হয়ে থাকে। এই রক্ত পরীক্ষা দু’ধরনের হয় :
কোয়ালিটেটিভ টেস্ট (Qualitative test) : এই পরীক্ষায় শুধু জানতে পারবেন, আপনি কনসিভ করেছেন না করেননি। অবশ্যই এইচসিজি (HCG) মাত্রার ওপর নির্ভর করে।
কোয়ানটিটেটিভ টেস্ট (Quantitative test) : এই টেস্টে রক্তে উপস্থিত এইচসিজি (HCG)-এর মাত্রাও সঠিকভাবে নির্ধারিত হয়।
কনসিভ করার ৭-১২ দিনের মধ্যেই রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে প্রেগন্যান্সি টেস্ট করা যায় এবং ফলাফল পাওয়া যায়।
ইউরিন টেস্টের জন্য সেখানে ১০-১৪ দিন অপেক্ষা করতে হয়।
৪. কখন করবেন প্রেগন্যান্সি টেস্ট?
সফল সহবাসের পরে মোটামুটি কখন কনসিভ করতে পারেন , তার একটা আন্দাজ করে নিন।
তার থেকে ১৪ দিন পরে প্রেগন্যান্সি টেস্ট কিটের মাধ্যমে ইউরিন টেস্ট করুন।
একদম সকালের প্রথম ইউরিন নিয়ে এই টেস্ট করুন।
কারণ, এ-সময়ে মূত্র বা ইউরিনে এইচসিজি (HCG) হরমোনের ঘনত্ব সব থেকে বেশি থাকে।
আর তাই, সঠিক ফলাফল আসার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
আর শরীরে খুব ক্লান্তিভাব, মর্নিং সিকনেসের মতো উপসর্গ দেখা দিলে, মাথা ঘুরলে বা পিরিয়ড মিস হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে রক্ত পরীক্ষা করতে পারেন।
৫. ঘরোয়া পদ্ধতিতে প্রেগন্যান্সি টেস্ট
বাজারে অনেক নামী-দামি কোম্পানির প্রেগন্যান্সি টেস্ট কিট পাওয়া যায় বটে, কিন্তু সবসময় তা হাতের কাছে মজুত থাকে না।
আবার আপনি হয়তো অধৈর্য হয়ে পড়ছেন, এখনই টেস্ট করবো এই ভেবে। তা হলে উপায়? উপায় আছে, কিছু ঘরোয়া পদ্ধতি।
তবে এই পদ্ধতির ফলাফল কতটা যথাযথ তার সিদ্ধান্ত নেবেন আপনার চিকিৎসক। আপনি প্রাথমিকভাবে এক-দু’বার চান্স নিতেই পারেন।
ঘরোয়া পদ্ধতিতে প্রেগন্যান্সি টেস্টের কয়েকটি পদ্ধতি
চিনির সাহায্যে : সকালের প্রথম মূত্র সংগ্রহ করে রাখুন। এবার ওতে এক চামচ চিনি মিশিয়ে দিন।
যদি চিনি দলা পাকিয়ে যায়, তা হলে সম্ভবত আপনি গর্ভবতী।
টুথপেস্টের সাহায্যে : ইউরিনের নমুনার মধ্যে কিছুটা টুথপেস্ট মিশিয়ে দিন।
কিছুক্ষণ পরে যদি ওই মিশ্রণে বুদবুদ ওঠে এবং মিশ্রণের রং পরিবর্তন হয়ে নীল হতে শুরু করে, তা হলে হয়তো আপনি মা হতে চলেছেন।
বেকিং সোডার সাহায্যে : একটি কাপে সকালের ইউরিন সংগ্রহ করুন। এতে দুই টেবিল চামচ বেকিং সোডা মিশিয়ে দিন।
যদি মিশ্রণটি ছানার মতো কেটে যায়, তা হলে সম্ভবত আপনি প্রেগন্যান্ট।
ভিনিগারের সাহায্যে : সকালের সংগ্রহ করা ইউরিনে সাদা ভিনিগার মিশিয়ে দিন।
মিশ্রণটির রং যদি পরিবর্তন হয়ে যায়, তা হলে আপনি হয়তো কন্সিভ করেছেন।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ
- বাড়িতে প্রেগন্যান্সি টেস্ট কিট দিয়ে যদি সঠিক ভাবে, সঠিক সময় মেনে ইউরিন টেস্ট করেন, তা হলে ফলাফল সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা কিন্তু ৯৯ শতাংশ। তবে আপনি প্রেগন্যান্ট না নয়, এ বিষয়ে চরম সিদ্ধান্ত নেবেন আপনার ডাক্তার।
- টেস্ট কিটে পজিটিভ রেসাল্ট এলে যত জলদি সম্ভব ডাক্তার দেখান ১০০ শতাংশ নিশ্চিত হওয়ার জন্য। এ ছাড়া কনসিভ করার পরে কিছু ওষুধপত্র প্রয়োজন হয় বা জীবনযাত্রায় পরিবর্তন প্রয়োজন হয় অনেকের। সে বিষয়ে আলোকপাত করবেন চিকিৎসকই।
- পিরিয়ড মিস হওয়ার পরের দিনই যদি কিটে রেসাল্ট নেগেটিভ আসে, তা হলে কয়েকদিন পরে আবার চেষ্টা করুন। শরীরকে যথেষ্ট মাত্রায় এইচসিজি হরমোন তৈরি করার সময় দিন।
- যখন কনসিভ করার সম্ভাবনা আছে, তার থেকে ১০-১৪ দিন পরে যদি রেজাল্ট নেগেটিভ আসে, তবে পিরিয়ড মিস হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। তার পর আবার টেস্ট করুন।
- যদি শরীরে হঠাৎ কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করছেন বা আপনার মনে হচ্ছে আপনি কনসিভ করেছেন, অথচ টেস্ট কিটে রেজাল্ট নেগেটিভ আসছে, তা হলে একবার ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
- অযথা উদ্বেগ করবেন না। আনন্দে থাকুন, নিজেকে নিয়ে সতর্ক থাকুন, শরীরের কোনো অস্বস্তি চেপে না রেখে ডাক্তার দেখান, যে কোনো অসুবিধা থেকে রক্ষা পাবেন।
শুভ কামনা। সতর্ক থাকুন, ভালো থাকুন।
—ডেস্ক পেরেন্টিং