গত কয়েক মাস ধরেই প্রত্যেক মাসের পয়লা তারিখে আপনার একটাই ভাবনা মাথায় আসে, যেন এবার পিরিয়ডস না হয়। অথচ আপনার আশায় ছাই ঢেলে, সময় এলেই স্বমূর্তি ধরে চলে আসছে সে।
অথবা ধরুন, যেহেতু কনসিভ করার চেষ্টা করছেন, তাই একটু অন্যরকম আঁচ পেলেই ছুটছেন ডাক্তারের কাছে, কিন্তু গর্ভধারণ (প্রেগন্যান্সি) রিপোর্টে ফলাফল সেই নেগেটিভ।
আবার হয়তো, আপনারা দুইজন আপনাদের একজনকে আনার চেষ্টায় যত না অস্থির, আশেপাশের আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, কিংবা পুরো দেশের মানুষ তাকে দেখার আশায় তার থেকে বেশি অস্থির হয়ে বসে আছে।
কানের কাছে শুনছেন কারো-না-কারোর ফিসফিসানি…
তাহলে চেষ্টা করেও কেন গর্ভধারণ হচ্ছে না, নাকি অন্য কোনো সমস্যা…
গর্ভধারণ-এ সমস্যা কেন হচ্ছে?
চারিদিকের চাপ, চেষ্টা করেও মা না-হতে পারার ডিপ্রেশন আর তথাকথিত শুভাকাঙ্ক্ষীদের বাঁকা কথার চাপে যেন অতিষ্ট হয়ে উঠেছেন।
জানেন কি, ৩৫ বছর বয়সের নিচে নারীদের ডাক্তাররা অন্তত ১ বছর কনসিভ করার চেষ্টা করতে বলেন।
নারীর বয়স ৩৫-৪০ হলে ৬ মাস চেষ্টা করতে বলেন এবং তার পর চিকিৎসা শুরু করতে বলেন।
সমস্যার গোড়ায় না-গিয়ে শুধু মন খারাপ করে চোখের জল ফেললে, তাবিজ-কবজ বাঁধলে বা উদ্বেগে চোখের তলায় এক গামলা কালি ফেলে যে কিছুই হবে না, এটা বোঝেন তো?
কনসিভ করতে অসুবিধা হওয়ার কারণ জেনে তার যথাযথ চিকিৎসা করালে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সুফল পাওয়া যায়। আর আপনার কাছে সুফল মানে কোল ভরে সোনা যাদু।
অনেকদিন চেষ্টা করেও, কনসিভ করতে না-পারার পেছনে প্রধান ৬টি কারণ :
১. সঠিক ওভ্যুলেশন না-হওয়া
কনসিভ করার জন্য নারীদের শরীরে ওভ্যুলেশন প্রক্রিয়া নিয়মিত হওয়া খুবই প্রয়োজন।
সাধারণত, একটি নিয়মিত মাসিক চক্রের ১২-১৮ দিনের মধ্যে নারীদের শরীরে ওভাম বা এগ নিঃসরণ হয়।
এই ওভামকেই নিষিক্ত করে শুক্রাণু বা স্পার্ম এবং সৃষ্টি হয় ভ্রূণের।
শারীরিক নানা অসুবিধার কারণে বাধা পেতে পারে এই ওভ্যুলেশন। ওভ্যুলেশনে বাধা সৃষ্টিকারী সম্ভাব্য কারণগুলি হলো :
- পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম (Polycystic ovary syndrome)-এর কারণে শরীরে হরমোনের তারতম্য ঘটে, এবং ওভারিতে ছোট ছোট সিস্ট থাকার কারণে ওভারির এগ রিলিজে বা ওভ্যুলেশনে সমস্যা হয়।
- ওভারিতে টিউমার থাকলে।
- শরীরে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি প্রোল্যাকটিন হরমোন তৈরি হলে তা ইস্ট্রোজেন হরমোনের স্বাভাবিক মাত্রা কমিয়ে দেয়। এর ফলেও ওভ্যুলেশন ক্রিয়া ব্যাহত হতে পারে।
- কোনো অসুস্থতার কারণে বা জিনগত বৈশিষ্ট্যের কারণে ৪০ বছরের আগেই ওভারি থেকে আর ওভাম বা ডিম তৈরি হয় না। এর পোশাকি নাম প্রিম্যাচিওর ওভারিয়ান ফেলিওর।
- শরীরে থাইরয়েড গ্রন্থির অস্বাভাবিকতা।
২. ফ্যালোপিয়ান টিউবে ব্লকেজ
জরায়ু এবং ওভারির মধ্যে সংযোগ সূত্র হিসেবে কাজ করে ফ্যালোপিয়ান টিউব। এই ফ্যালোপিয়ান টিউবেই ডিম্বাণু আর শুক্রাণু মিলিত হয় ও নিষেক সম্পূর্ণ হয়।
তাই যদি এই টিউবে ব্লকেজ বা বাধার কারণে ডিম্বাণু আর শুক্রাণু মিলিত হতে না পারে, তবে একজন নারী কনসিভ করতে পারেন না।
এ ছাড়া যৌন সংক্রমণের কারণে জরায়ু ও ফ্যালোপিয়ান টিউবে ইনফেকশন হয়ে থাকে। ডাক্তারি ভাষায় যার নাম পেলভিক ইনফ্লাম্যাটরি ডিজিস (Pelvic inflammatory disease)।
এর কারণে কনসিভ করতে সমস্যা হয়।
এক্টোপিক প্রেগন্যান্সির কারণে যদি ফ্যালোপিয়ান টিউব ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বা অন্য কোনো অপারেশনের ফলে ফ্যালোপিয়ান টিউব বাদ চলে যায়, তা হলেও গর্ভে ভ্রূণ আসতে সমস্যা হয়।
৩. অস্বাভাবিক জননতন্ত্র
কোনো নারীর জননতন্ত্র যদি জন্মগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বা অস্বাভাবিক হয়, তা হলে তিনি স্বাভাবিক উপায়ে কনসিভ করতে পারেন না। তখন গর্ভধারণ-এ সমস্যা হয়।
৪. এন্ডোমেট্রিওসিস সমস্যা
জরায়ু বা ইউটেরাসের গায়ে যে আবরণ থাকে, তাকে এন্ডোমেট্রিয়াম বলে। পিরিয়ডসের সময় এই এন্ডোমেট্রিয়ামের গঠন সম্পূর্ণ হয়ে যায়।
ওভাম নিষিক্ত না-হলে, এই এন্ডোমেট্রিয়াম পর্দা জরায়ু থেকে ছিঁড়ে মাসিকের রক্তস্রাবের মাধ্যমে আমাদের শরীর থেকে বের হয়ে যায়।
এই এন্ডোমেট্রিয়াম যখন জরায়ুর ভেতরে ছাড়াও জরায়ুর বাইরে, ওভারি, ফ্যালোপিয়ান টিউব এবং মলাশয়ের দেওয়ালেও আবরণ তৈরি করে, তখন তাকে এন্ডোমেট্রিওসিস বলা হয়।
এন্ডোমেট্রিওসিসে আক্রান্ত নারীদের পিরিয়ডসের সময় তলপেটে অসহ্য ব্যথা হয় এবং স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি রক্তপাত হয়।
কারণ, এই সময় অস্বাভাবিক স্থানে গজিয়ে ওঠা এন্ডোমেট্রিয়ামও ছিঁড়ে ব্লিডিংয়ের মাধ্যমে বেরিয়ে আসে।
আবার ওভারিতে ‘চকোলেট সিস্ট’ হওয়ার নেপথ্যেও আছে এই এন্ডোমেট্রিওসিস রোগ।
এর ফলে, নারীদের স্বাভাবিক জননক্রিয়া বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং গর্ভধারণ-এ অসুবিধা হয়।
৫. বয়স বেড়ে গেলে
বয়স যখন কুড়ির ঘরে, তখন মেয়েদের শরীর প্রেগন্যান্সির জন্য খুব ভালো ভাবে প্রস্তুত থাকে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০-২৯ বছর বয়সের মধ্যে মেয়েদের কনসিভ করার সম্ভাবনা বহুগুণে বেশি থাকে এবং ওভামের গুণগত মান উন্নত থাকে।
প্রেগন্যান্সির সাথে জড়িত নানা অসুখ-অসুবিধাও এ-সময় অপেক্ষাকৃত কম হয়।
নারীদের বয়স ৩৫ ও পুরুষদের বয়স ৪০ পেরিয়ে গেলে, কনসিভ করতে নানারকম সমস্যা দেখা দেয়।
৬. পুরুষসঙ্গীর শারীরিক সমস্যা
হ্যাঁ, ঠিকই বলছি। কনসিভ করতে অক্ষমতা শুধু নারীর শারীরিক অসুস্থতা বা অপারগতা একেবারেই নয়।
অনেক সময় পুরুষ সঙ্গীর শারীরিক অসুবিধাও প্রেগন্যান্সি আসতে বাধা দেয়।
আমাদের একচোখা সমাজ সবসময় নারীদেরই আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে, আঙুল তুলেছে বন্ধ্যা বলে। কিন্তু কখনোই জানতে চায়নি পুরুষের অক্ষমতা।
জানেন কি, বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসা করাতে আসা দম্পতিদের প্রায় ১/৩ ভাগের সমস্যা পুরুষজনিত থাকে?
স্পার্ম-এর গুণগত মান খারাপ হওয়া, স্পার্ম ঠিক মতো তৈরি না-হওয়া, টিউমার, ইজাকুলেশনে সমস্যা এবং হরমোনের মাত্রার অস্বাভাবিকতা স্বাভাবিক জনন ক্রিয়ায় বাধা দেয়।
এ ছাড়া অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন বা ধূমপান, অতিরিক্ত ওজন এবং বেহিসেবি জীবনযাত্রা পুরুষদের ফার্টিলিটি কমিয়ে দেয়।
ফলস্বরূপ, সঙ্গী নারীটি কনসিভ করতে পারেন না।
চেষ্টা করেও গর্ভধারণ হচ্ছে না, আরো কিছু সম্ভাব্য কারণ
- অত্যধিক ওজন, অ্যালকোহল সেবন, ধূমপান, এ ছাড়া নিজের ইচ্ছে মতো ওষুধ খাওয়ার পরোক্ষ প্রভাব কনসিভ করতে বাধা দেয়।
- জরায়ুতে ফাইব্রয়েড এবং পলিপ থাকলে কনসিভ করতে সমস্যা হয়।
- এ ছাড়া অনেকের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক সারভিকাল মিউকাসও বন্ধ্যাত্বের জন্য দায়ী। এই ধরনের মিউকাস স্পার্মকে ওভামের কাছে পৌঁছতে দেয় না এবং নিষেকে বাধা দেয়।
- আগে কোনো জটিল অসুখে ভুগে থাকলে কনসিভ করার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি হতে পারে।
- কোনো কোনো ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ সুস্থ দুই সঙ্গীর বাচ্চা হতেও সমস্যা দেখা দেয়। যার সঠিক কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না।
সঠিক জীবনযাত্রা ও নিজেদের প্রতি সতর্কতা—এই সমস্যা অনেকাংশেই কমিয়ে আনতে পারে।
চেষ্টা করছি, তাও কেন কনসিভ করতে পারছি না, এভাবে সারাক্ষণ ভাবতে থাকলে হিতে বিপরীত হতে পারে।
অতিরিক্ত উদ্বেগ বা দুশ্চিন্তাও স্বাভাবিক উপায়ে কনসিভ করতে বাধা দেয়। কে কী বললো বা কী করলো—এসব দিকে মন এবং কান দুটোই দেবেন না।
একটা নির্দিষ্ট সময় চেষ্টা করুন। তার পর ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
আবার প্ল্যানিং-এর শুরুতেই ডাক্তার দেখিয়ে সমস্ত পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলেন, করতে পারেন এমনটাও।
চিকিৎসা-বিজ্ঞান এখন এতটাই উন্নত, আপনার প্রায় সব সমস্যার সমাধানই আছে তার কাছে।
তাই চিন্তা করবেন না, শুধু নিজের ও নিজের সঙ্গীর শরীর সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল থাকুন।
আপনার সোনামণির জন্য আগাম শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন রইল।
—ডেস্ক পেরেন্টিং