Honey during Pregnancy

গর্ভকালে মধু খাবেন, না খাবেন না! জেনে নিন উপকারিতা

হবু মা গর্ভকালে মধু খাবেন, না খাবেন না! দ্বিধায় না-পড়ে জেনে নিন মধুর নানা উপকারিতা।

গর্ভকাল এমন একটা সময় যখন শুধু হবু মা নন, তার আশেপাশের সমস্ত মানুষ ব্যস্ত হয়ে পড়েন মায়ের খাওয়াদাওয়া নিয়ে, কী খাবে আর কী খাবে না—এই বচসাতেই কেটে যায় দিনের একটা অংশ।

অনেক সময় সিদ্ধান্ত হয় সঠিক আবার অনেক সময় ভুল। ঠিক এমনই একটা খাবার মধু! মধুর মতো মিষ্টি, প্রাকৃতিক জিনিসও মাঝে মাঝে সন্দেহের প্রকোপে পড়ে যায়।

তবে কি জানেন, সবার শরীর যেমন সমান নয়, তেমনই একই খাবার/পথ্য আবার সবার জন্য ঠিক নয়। একই কথা খাটে মধুর ক্ষেত্রে!

কারো জন্য মধু খুব ভালো, আবার কেউ মধুকে না বললেই ভালো থাকেন। আর এই সতর্কতাগুলো আরো জোরদার হয় প্রেগন্যান্সির সময়।

প্রেগন্যান্সিতে মধু খাবেন কি খাবেন না, মধুকে নিয়ে কীসের সন্দেহ, খাঁটি মধু চিনবেন কীভাবে বা কতটা মধু খাওয়া সম্পূর্ণ নিরাপদ—

এরকম নানা প্রশ্নের চুলচেরা বিচারালোচনা রইল আজকের প্রতিবেদনে!

১. প্রেগন্যান্সিতে মধু খাওয়া কি ঠিক?

হ্যাঁ, গর্ভাবস্থায় বা প্রেগন্যান্সিতে মধু খাওয়া সম্পূর্ণ নিরাপদ।

যদি আপনার কোনোভাবে এলারজি না থাকে বা আপনার ডাক্তারবাবু কোনো নির্দিষ্ট কারণের খাতিরে আপনাকে মধু খেতে বারণ না করেন,

সেক্ষেত্রে প্রেগন্যান্সিতে আপনি নির্ভাবনায় মধু খেতে পারেন।

২. প্রেগন্যান্সিতে মধু খাওয়া নিয়ে সন্দেহ বা দ্বিধার সৃষ্টি হয় কেন?

একটি ছোট্ট বাচ্চার বয়স এক বছর না-হওয়া পর্যন্ত তাকে মধু খাওয়ানো উচিত নয়।

এ ছাড়া গর্ভাবস্থায় অনেক সাধারণ খাবারদাবারের ওপরও নানা বিধিনিষেধ চেপে যায়।

এইসব মাথায় রেখেই কখনো সখনো মধুকেও তোলা হয় কাঠগড়ায়। প্রেগন্যান্সিতে মধু খাওয়া উচিত কি-না, তাই নিয়েই দেখা দেয় দ্বিধাদন্দ্ব।

আদৌ কি সেগুলো সত্যি, সত্যি না-হলে বাস্তবে কী?
  • চাকভাঙা মধু সরাসরিই আমরা খাই। অর্থাৎ, এই মধু খাওয়ার আগে কোনো রকম ফোটানো, ধোওয়া বা সেদ্ধ করা হয় না, বা কঠিন ভাষায় বললে প্রসেসড হয় না। সরাসরি খাওয়া হয় বলে মধুতে থাকা এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া থেকে বটুলিজম নামের একটি কঠিন অসুস্থতার সৃষ্টি হতে পারে। মধুর ওই ব্যাকটেরিয়া আমাদের শরীরে ঢুকে বটুলিনাম নিউরোটক্সিন নামের উপাদান তৈরি করে—যা আমাদের শরীরের জন্য খুবই ক্ষতিকর এবং প্যারালাইসিসের মতো রোগও ডেকে আনতে পারে।
  • ভয় পেয়ে গেলেন? জানেন কি, এই ব্যাকটেরিয়া মাটি, ধুলো বা আপনার বাড়ির অধিকাংশ জিনিসপত্রে, যেমন—মেঝে, পর্দা এবং কার্পেটেও থাকে! সে আপনি যতই পরিষ্কার করুন না কেন! তা হলে মধু কী দোষ করলো? সত্যি বলতে, এক বছরের বড় বাচ্চা বা স্বাস্থ্যবান বয়স্কদের ওপর বটুলিজম সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারে না।
  • একদম ছোট্ট বাচ্চা, যাদের বয়স ১ বছরের কম তাদের জন্য মধু একেবারেই ঠিক নয়। মধু খারাপ থাকলে তাতে ক্লসট্রিডিয়াম স্পরস নামের ব্যাকটেরিয়া উপস্থিত থাকে এবং সেটা সরাসরি বাচ্চার পরিপাকতন্ত্রের ক্ষতিসাধন করে।
  • একটি বাচ্চার থেকে একজন বড় মানুষের পরিপাকতন্ত্র অনেক বেশি সুগঠিত ও শক্তিশালী হয়। তাই পূর্ণ বয়সের একজন গর্ভবতী নারী যদি মধু খান; সেক্ষেত্রে ব্যাকটেরিয়া ভ্রূণ পর্যন্ত পৌঁছতেই পারে না। তাকে আগেই আটকে দেয় মায়ের অমরা বা প্লাসেন্টা। কোনো ক্ষতিকর অ্যানটিজেন ভ্রূণ পর্যন্ত পৌঁছতেই পারে না, তাই বাচ্চার কোনো রকম ইনফেকশন হওয়ার আশঙ্কা থাকে না।
মধু তৈরির প্রক্রিয়া ও গুণগত পার্থক্য
  • যে কোনো ভালো কোম্পানির প্যাকেটজাত মধু পাস্তুরাইজড করা হয়। মধুকে ১৬১ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রায় ১৫-৩০ সেকেন্ড উত্তপ্ত করা হয় এবং খুব তাড়াতাড়ি ঠাণ্ডা করা হয়। এই পদ্ধতিতে মধুর মধ্যে থাকা ইস্ট কোষগুলি নষ্ট হয়ে যায় এবং মধু খুব তাড়াতাড়ি গেঁজে যায় না বা খারাপ হয়ে যায় না। পাস্তুরাইজড মধুর ক্ষেত্রে ক্রিস্টালাইজেশন প্রসেসও ধীরে হয়, যার ফলে মধু তাড়াতাড়ি জমাট বেঁধে যায় না। আবার বলছি, এই পদ্ধতিতে বটুলিজম স্পরগুলি কিন্তু নষ্ট হয় না। তবে তারা পূর্ণবয়স্ক মানুষের শরীরে কোনো ক্ষতি করতে পারে না।
  • যদি চাকভাঙা মধু খেতে চান, তবে সেটা ভালো বি-ফার্ম থেকে কেনাই ভালো। রাস্তার ধারে অনেকেই চাকভাঙা মধু বিক্রি করেন, আশেপাশের পরিবেশের দূষণের ফলে বা অসাবধানে হাত লেগে যার গুণগত মান অনেকটাই বদলে যেতে পারে।

৩. গর্ভাবস্থায় মধু খাওয়ার কী কী উপকারিতা

শুধু গর্ভাবস্থায় নয়, সাধারণ সময়েও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে খেতে পারেন মধু।

গর্ভাবস্থায় মধু খেলে হবু মা যে উপকারগুলি পাবেন
  • রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। মধুতে থাকা অ্যানটিঅক্সিডেনটস এবং মধুর অ্যানটিব্যাকটেরিয়াল ধর্ম মায়ের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং ইনফেকশনের হাত থেকেও রক্ষা করে।
  • কুসুম গরম জলে মিলিয়েই হোক বা চায়ের সাথে, নিয়মিত মধুসেবনে সর্দি-কাশি হওয়ার অথবা সাধারণ ঠাণ্ডা লাগার প্রবণতা কমে।
  • হঠাৎ গলা ব্যথা, সর্দি হলে আরাম দিতে পারে মধু। আদা, মধু, তুলসীর টোটকার কথা কে-না জানে বলুন? আদিকাল থেকে চলে আসা এই টোটকা ভীষণ কার্যকরী গর্ভবতী নারীদের জন্যও।
  • গর্ভবতী নারীদের মধ্যে অনিদ্রার সমস্যা খুব প্রবল। এর সমাধানও দিতে পারে মধু। রাতে শুতে যাওয়ার আগে ঈষদুষ্ণ দুধে মধু মিলিয়ে পান করুন। সুন্দর ঘুম হবে।
  • গ্যাসট্রাইটিসের রোগীদের দারুণ আরাম দেয় মধু। যেসব হবু মা স্টমাক আলসারের সমস্যায় ভোগেন বা গ্যাসট্রাইটিসের সমস্যা আছে, নিয়মিত মধু সেবনে তা সেরে যায় দ্রুত। তবে এই আলসার যেহেতু একটু গম্ভীর জিনিস, গর্ভাবস্থায় মধু হোক বা ওষুধ, ডাক্তারের অনুমতি ছাড়া খাওয়া উচিত নয় একেবারেই।
  • র‌্যাশ, এলারজি হওয়ার ধাতও কমিয়ে দিতে পারে। শরীর ভেতর থেকে চনমনে থাকলে বাইরের ত্বকেও তার প্রভাব দেখা যায়। আর নিয়মিত মধু সেবনে ঠিক তাই হয়।

৪. আসল মধু নকল মধু চেনার উপায়

যে মধুটা কিনছেন, তার গুণগত মান কেমন খুব সহজেই কিন্তু সেটা বুঝে ফেলা যায়। কীভাবে?

মধু চেনার উপায় বলছি
  • আসল মধু দুই আঙুলের মাঝে নিয়ে ঘষলে কোনো চ্যাটচেটে ভাব পাবেন না। নকল মধু কিন্তু চ্যাটচেটে হয়; কারণ মিষ্টতা বাড়ানোর জন্য ওতে চিনি এবং অন্য মিষ্টি পদার্থ মেশানো হয়।
  • আসল মধু একটু ঘন হয় এবং পাত্রের মধ্যে সহজেই নাড়াচাড়া করে না; মধু ভালো না-হলে তা পাত্রের মধ্যে তরলের মতো নাড়াচাড়া করে।
  • আসল মধু জলে তাড়াতাড়ি গুলে যায় না।
  • ব্লটিং পেপার আসল মধু সহজেই শুষে নিতে পারে না। নকল মধু ব্লটিং পেপার সহজেই শুষে নেয়।
  • এ ছাড়া আসল মধুতে কিছু অবিশুদ্ধ জিনিস থাকে—যা পাত্রের নিচে থিতিয়ে পড়তে দেখা যায়। নকল বা বিশুদ্ধ নয় এমন মধু একদম পরিষ্কার হয়।

৫. গর্ভাবস্থায় মধু খেলে তার কোনো বিরূপ প্রভাব আছে কি?

কিছু ব্যতিক্রম তো সবক্ষেত্রেই থাকে, তাই না? প্রেগন্যান্সিতে অনেক সময়ই কারো কারো জেসটেশনাল ডায়াবেটিস বা গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের উদ্রেক হয়।

যদি এই ধরনের সমস্যা হয়ে থাকে, তা হলে মায়েদের নিয়মিত ব্লাড সুগার চেক করাতে হয়।

মধুতেও গ্লুকোজ থাকে বলে, কেউ যদি ডায়াবেটিস থাকা সত্ত্বেও মধু খেয়ে যান, সেটা ঠিক নয়।

৬. মধু খাবেন অবশ্যই, তবে এই সাবধানতাগুলি মেনে

  • মধু গরম জলে ফেলে ফুটিয়ে খাবেন না বা রান্না করার সময় মধু মেলাবেন না। কোনো খাবারে মধু মেলাতে হলে গ্যাস থেকে নামিয়ে একটু ঠাণ্ডা করে মধু মেলান। মধু ফোটালে বা খুব গরম জলে দিলে এর গুণাগুণ নষ্ট নয়।
  • সবকিছুই খাওয়া ভালো, কিন্তু নির্দিষ্ট মাত্রায়। বেশি মাত্রায় কোনো জিনিসই খাওয়া ভালো নয়, তা সে যত খাদ্যগুণসম্পন্নই হোক। একই কথা খাটে মধুর ক্ষেত্রে। অতিরিক্ত মধু সেবনে পেটে ব্যথা, ডায়রিয়া, অস্বস্তি হতে পারে।
  • ভালো ব্র্যান্ডের প্যাকেটজাত মধুই খান সবসময়।

প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী

ক. প্রেগন্যান্সিতে কতটা মধু খাওয়া নিরাপদ?

স্বাস্থ্য সচেতন অনেকেই চিনির বদলে মধু খাওয়া পছন্দ করেন। গর্ভবতী হলেও সেটা করা যায়, তবে সাধারণ মাত্রায়।

সারাদিনে ৩-৪ টেবিলচামচের বেশি মধু খাওয়া ঠিক নয়। মধু ফ্রুকটোজ, গ্লুকোজ এবং মলটোজের অন্যতম উৎস হওয়ায় যথেষ্ট ক্যালোরির জোগানও দেয় শরীরকে।

খ. খাওয়া ছাড়াও অন্য কোনো ভাবে কি মধু ব্যবহার করা যায়?

মধু ব্যবহার করুন ত্বক ও চুলের চর্চাতেও। ফেস প্যাক বা হেয়ার প্যাক, মধু মিলিয়ে নিলে বেড়ে যায় তার গুণাগুণ।

গ. প্রেগন্যান্সিতে কাদের মধু খাওয়া উচিত নয়?

ডায়াবেটিস থাকলে বা গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের সমস্যা থাকলে মধু খাবেন না।

এ ছাড়া আপনার শরীরের পরিস্থিতি বিচার করে আপনার ডাক্তার বা ডায়েটিশিয়ান যদি আপনাকে মধু খেতে বারণ করে, তবে মধু খাবেন না।

অতএব, মধু খাওয়া সবার জন্য মোটেই খারাপ নয়।

মা হতে চলেছেন, শরীর এখন নরম, তাই নিজের একটা ডায়েট চার্ট বানিয়ে নিন ডাক্তারকে বলে। সঙ্গে জেনে নিন কতটা মধু খাবেন আপনি!

মেনে চলুন ওনার কথাই। আর যদি, মধু খেতে বারণ করেন ডাক্তার, না হয় মা হয়ে যাওয়ার পরেই আবার ‘মৌমাছি’ হবেন।

—ডেস্ক পেরেন্টিং

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published.